আ মরি বাংলা ভাষা : মাতৃভাষা কাহিনী এবং উইকিমিডিয়া উইকিমিট

আপনি হয়তো এই বিষয়ে অবগত যে আগামী ১৯ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে উইকিমিডিয়া উইকিমিট নামক একটি কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এইটি একটি সম্পূর্ণ-অনলাইন অনুষ্ঠান হবে এবং আমরা এই অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু (“নতুন” কিনা জানি না) চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগের ইচ্ছে রাখি। যখন বোধিসত্ত্ব মন্ডল, নিতেশ গিল, আর আমি মিলে তনবীর হাসানের সাথে আলোচনা করে এই উইকিমিটের ভাবনাটি ভেবেছিলাম, তখন প্রথম যে কথাটি মাথায় ছিল সেইটি হল বেশ কিছু “এমন হলে কেমন হত?” চিন্তার প্রয়োগ করা। তা এখন এই অনুষ্ঠান কেমন হবে, তা আপাততঃ মা দুর্গাই জানেন। আর তা সে যেমনই হোক আমরা সকলে মিলে বেশ কিছু নতুন জিনিস শিখতে পারবো, এই আশা রাখি।

অমর একুশে, শহীদ মিনার, ঢাকা, চিত্র ঋণ: Mostaque Ahammed, Shaheed Minar, CC BY-SA 2.0

লক্ষ্য করলে দেখবেন এই অনুষ্ঠানের তারিখ হলো ১৯ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিনগুলি আমরা ভাবনা-চিন্তা করেই বেছেছি। ২১শে ফেব্রুয়ারি হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিন শুধু বাংলা বা বাঙালির না, এই দিন সেই সকলের জন্য যাঁর হৃদয়ে তাঁর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হয়। মাতৃভাষা কোনো চাপিয়ে দেওয়া বোঝা না, যে সেটিকে বয়ে বেড়াতে হবে। মাতৃভাষা যেন প্রাণের কাছাকাছি থাকা একটা কিছু। বিভিন্ন ভাষার উইকিপিডিয়া, উইকিসংকলন, উইকিঅভিধান ইত্যাদি উইকিমিডিয়া প্রকল্পে বহু স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন যাঁরা তাঁদের মাতৃভাষার জন্য নিরলস, নিরবধি তথা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, এই দিন তাঁদেরও দিন। তা তিনি বাংলা জানুন বা না জানুন তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকলের মাতৃভাষার দিন। এই রকম কিছু কথায় মাথায় রেখে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটাকে চয়ন করা হয়েছে, এবং অনুমান করি এই দিনের অনুষ্ঠানসূচীতে মাতৃভাষা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা ইত্যাদি থাকবে।

যেইহেতু আমার মাতৃভাষা বাংলা, সেইহেতু এই লেখাটি বাংলাতেই লিখছি। এই উইকিমিডিয়া দুনিয়ায় আমার অনেকদিন থাকা হয়ে গেল। আসছে বসন্তে আমার উইকিদুনিয়ায় এক দশক পূর্ণ হবে। এই এক দশক আমার কাছে অনেক দিন। মাঝে মাঝেই ভাবি কোথায় ছিলেম, কোথায় এলেম, কীভাবে এলেম — সব ভারি অদ্ভুত আর চমকপ্রদ। আর এর পরের পথ, আর সে পথের যাত্রা কেমন হবে তাও পুরোটাই অজানা। বছর দশেক আগে আমি কিন্তু উইকিদুনিয়ায় বাংলা নিয়ে কাজ শুরু করিনি, লক্ষ্য করলে দেখবেন আমার উইকিকাজের একটা অতি বড় অংশই ইংরেজি উইকিপিডিয়ায়। আর বাকি দশজনের মতো গুগলে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ঢুকে পড়েছিলাম, আর তার পরে যা হয়— একটা ছোট সম্পাদনা, আরেকটা ছোট সম্পাদনা, খানেক পরে হয়তো কয়েকটা বড়ো সম্পাদনা— এই করে করে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়লাম, আর দশটা বছর কেটে গেল। ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সাথে বাঁধনে জড়িয়ে আছি, কেমন সে বাঁধন তা না হয় অন্যদিন বলবো, কেননা তার জন্য আলাদা গল্প, গল্পের পটভূমির, আর নিঝুম নিশিরাতের প্রয়োজন। মূল কথা যদিও ব্যক্তিজীবনে আমার বাংলাভাষা নিয়ে বিশেষ আবেগ ছিল, উইকিদুনিয়ায় আমার কাজের একটা বড় অংশ বাংলাভাষা নিয়ে নয় বা ছিল না।

একটা ভাষাকে অনেক সময়ে নদীর প্রবহমানতার সাথে তুলনা করা হয়। চিত্র ঋণ: Davi1974d, El amanecer en el Ganges. Varanassi, CC BY-SA 3.0

বছরের পর বছর যখন উইকিদুনিয়ায় কাজ করছি, বহুবার লক্ষ্য করেছি বহু মানুষকে যাঁরা নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে কি অসাধারণ কাজটাই না করছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছরের অবিশ্রান্ত আর নিঃস্বার্থভাবে এঁরা কাজ করে চলেছেন যাতে উইকি আর ওয়েবদুনিয়ায় তাঁদের মাতৃভাষার স্থান কিছু উন্নত হয়। এঁরা পথিকৃৎ। আজ যদি আমি ইন্টারনেটে বাংলায় কিছু পেয়ে থাকি, তার কারণ গতকাল কেউ কেউ এর ওপর কাজ করেছিল। একইভাবে যদি কাল আমি ইন্টারনেটে আরো ভালোভাবে বাংলা পাই, সেটার কারণ হবে গতকাল আর আজ মিলিয়ে বেশ কিছু মানুষের করা অনেকটা কাজ। এই পরম্পরা বোধ করি সকল ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু ভেবে বলুন দেখি কী হবে যদি কোনো একটা ভাষা নিয়ে আজকের কাজটা কেউ না করে? কাল কি একটা ভাষা, যেটা অনেকের মাতৃভাষা, অল্প হলেও পিছিয়ে পড়বে না? আর এই পিছিয়ে পড়া যদি ক্রমাগত হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে?

আমি উইকিদুনিয়ায় অনেক মানুষকে মাতৃভাষা নিয়ে দারুণ দারুণ সব কাজ করতে দেখেছি। বিভিন্ন ভাষায়। তা সে কান্নাডা হোক, তামিল হোক, তেলুগু হোক, পঞ্জাবি হোক, অথবা হিব্রু, বা বাংলা। আমি ঠিক করেছিলাম যে এই লেখায় আমি কোনো ব্যক্তির নাম আর কাজের কথা উল্লেখ করবো না, নইলে তালিকা আর তার সাথে লেখা অত্যন্ত বড় হয়ে যাবে। আর আমি বোধ করি আর কারো মাতৃভাষার কাহিনী গুছিয়ে লিখতেও পারবো না। ইচ্ছে আছে এই লেখার পরে আমি কয়েক জনের কাছে যাব আর বলবো “দেখো হে, এই আমি একটা ছোট মাতৃভাষা-কাহিনী লিখেছি। তুমিও কি তোমার মাতৃভাষার কাহিনী আমাদের শোনাবে?” যদিও আমি ঠিক করেছিলাম এই লেখায় কোনো ব্যক্তির কাজের কথা লিখবো না, তবে এক জনের নাম বলা অত্যন্ত আবশ্যক— তিনি আফতাবুজ্জামান। বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসক। বাংলা ভাষা নিয়ে উইকিতে ও আরো অন্যান্য জায়গায় কাজ করছেন। গত দেড়-দুই বছর ধরে আমি বাংলা নিয়ে উইকিদুনিয়ায় কাজ বেশ কিছুটা বাড়িয়েছি। একটা সময়ে উইকিউপাত্তে বাংলা লেবেল নিয়ে কাজ করছিলাম, এখন মাস ছয়েক ধরে উইকিমিডিয়া কমন্সে বাংলা শব্দের শ্রুতি নিয়ে কাজ করছি। বাংলা শ্রুতি নিয়ে এই কাজের জন্য আমি বেশ অনেকটা সময় দিয়েছি, আশা করছি এইটি আপাততঃ চালিয়ে যাব। আজ যদি আপনি আমার গুগল একাউন্ট বা ফেসবুক দেখেন, দেখবেন তা বাংলায়। যদি আপনি আমার মোবাইল দেখেন দেখবেন তাও বাংলায়। এই যে আমি দিন-দিন বাংলাভাষা নিয়ে আরো সচেতন হচ্ছি, তার একটা কারণ হয়তো, চোখের সামনে দেখা আফতাবের কাজ হয়তো আমার অবচেতন মনে ক্রিয়া করেছে। তাই এই একটা নাম উল্লেখ প্রয়োজন ছিল।

মাতৃভাষা এবং একটি অনুধাবন।

সুব্দরবন অঞ্চলে বনবিবি মন্দির। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তৈরি। চিত্র ঋণস্বীকার: A. J. T. Johnsingh, WWF-India and NCF, Bonbibi temple in Sundarbans (2), AJTJ DSCN5427, CC BY-SA 4.0

বেশ কিছু সময় ধরে যখন আমি উইকিতে মাতৃভাষা-চর্চা করছি, আমি একটা জিনিস অনুধাবন করেছি। একটু আগে বলেছিলাম “মাতৃভাষা কোনো চাপিয়ে দেওয়া বোঝা না, যে সেটিকে বয়ে বেড়াতে হবে”— সেই বিষয়ে। বলুন তো “ইন্টারনেট”-এর বাংলা কী? “ওয়াই-ফাই”-এর বাংলা? “সিম কার্ড”-এর বাংলা? “র‍্যাম”-এর বাংলা? যদি আপনি বাংলা বা আর যে কোনো ভাষা দেখেন তবে দেখবেন প্রচুর সংখ্যক দৈনন্দিন শব্দ রয়েছে যার কোনো প্রতিশব্দ নেই (বা থাকলেও কেউ ব্যবহার করে না)। “ওটিপি” কে “ওটিপি”-ই বলে, “ল্যাপটপ”কে “ল্যাপটপ” ইত্যাদি। তা এর কারণ কী? আমার মনে হয় এর একটা কারণ এও হতে পারে যে শুধু শব্দ না, এইটা স্বাধীন চিন্তার অভাবকেও চোখে আঙুল দিয়ে লক্ষ্য করায়। আমরা হয়তো দিন দিন স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। এই ইন্টারনেট, র‍্যাম, সিম কার্ড, ল্যাপটপ ইত্যাদি একটা শব্দেরও বাংলা নেই, লক্ষ্য করে দেখুন এর একটাও আমাদের নিজস্ব চিন্তা নয়, নিজস্ব সৃজন নয়। বাইরে থেকে এসেছে, আমরা নিয়ে নিয়েছি, বা কিনে নিয়েছি। ভাবি নি। চিন্তা করিনি। নাম দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। অপর দিকে আমাকে একটা জিনিস দেখান যেটা আমরা নিজেরা চিন্তা করে বানিয়েছি অথচ নাম দিইনি? ধানসিঁড়ি, আকাশপ্রদীপ, জালকাঠি, ছৌ নাচ, নকশী কাঁথা, পুলি-পিঠে কোথায় কবে শব্দের অভাব হয়েছে? এর জন্য ভাষাবিদ্যা লাগেনা। হয়তো স্বাধীন চিন্তার অভাব। তাই নিজের মাতৃভাষা না জানা বা তা নিয়ে চিন্তা না করা বোধ করি শুধুমাত্র ভাষাগত নয়, হয়তো আরো বড় সমস্যা। একটু ভেবে দেখতে পারেন।

উইকিমিডিয়া উইকিমিটে, এবং তার আগে এবং পরে ভাষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রইলো। তা এই হলো আমার মাতৃভাষার ছোট কাহিনী। আপনার মাতৃভাষা কাহিনী শোনার অপেক্ষায় থাকবো।

আরও দেখুন