অনেক না জানা কথার সাথে সাথে জানতে পারলাম,দিদা কিছুদিন আগেই একটি কম্পিউটার কোর্স করেছেন, একটি প্রতিষ্ঠানে। আমি সত্যি বেশ অবাক হলাম। হয়ত খুবি সাধারন ব্যাপার, কিন্তু তাও, কজন মানুষ এটা রোজ পারেন? উনি তো জানতেন, ওনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটরাই হয়ত থাকবে সাথে, শিখবে যারা তারা তো বটেই, যারা শেখাবেও!
আমি খানিক তাকিয়ে রইলাম, এই মহিলার দিকে, চুপ করে। জানিনা কেন, আমার শুধু মনে হতে লাগলো, উইকিপিডিয়ার সাথে, এই মানুষটির পরিচয় করানোটা কি পরম দরকারি!দেরি করিনি তাই,আমরা বাংলা উইকিপিডিয়ায় একটা একাউন্ট তৈরি করলাম প্রথমে। মনে আছে, আমি জিগ্যেস করেছিলাম দিদাকে, “কি নাম রাখবে বল নিজের? সারা পৃথিবীটাকে চেনাতে হবে তো নিজেকে!” দিদা কিছুটা সময় চুপ করে থাকার পর, খুব ধীরে ধীরে, সুন্দর করে উচ্চারণ করলেন, “সহজকথা।” আমি তাকালাম ওঁর দিকে, দিদা অল্প হেসে বললেন, ” আমার নাম জানতে চাইলি তো? আমার নাম হবে সহজকথা!”
কিভাবে এক একটা মুহূর্ত তৈরি হয়ে যায়!সত্যিই তো, কতগুলো সহজ কথা ছাড়া, আর কী বা বলার থাকতে পারে, আমাদের এই বিশাল অভিধানটাকে? আমি দিদাকে গুছিয়ে গুছিয়ে অনেক কথা বলছিলাম, সম্পাদনা ছাড়াও,বলছিলাম কি বিপুল এই ভাবনা! কিভাবে এই হিংসা, মারামারির দুনিয়ায়, এখনো কয়েক লক্ষ মানুষ শুধু ভেবে চলেছ, আরো কয়েক কোটি মানুষের কাছে কীভাবে সহজপ্রাপ্য হবে জ্ঞান, তথ্য। কীভাবে তারা প্রত্যেকদিন আরো কয়েক লক্ষ মানুষকে বোঝানোর ছেষ্টা করে চলেছেন,কি ভীষণ সংক্রামক করে তুলতে হবে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার অভ্যেস!আর দিদা চুপ করে শুনছিল সব, একদম লক্ষী ছাত্রী যেন। কিজানি আমার কেমন মনে হচ্ছিল, দিদা দেখতে পাচ্ছে সামনে কত নতুন একটা জগৎ,তার কতকিছু অজানা, অথচ কতকিছু জানার হাতছানি সেখানে। হয়ত ভাবছিলেন, পৃথিবীটা কত বদলে গেছে এখন,বদলে যাচ্ছে প্রতিদিনই আরও একটু করে, কিন্তু এই একটা বদল যেন খুব শান্তির, খুব দরকারি কিছু, ভালো কিছু!
পরের দিন দুপুরবেলা, আমরা আবার বসলাম একসাথে। দিদাকে বহুবার কাজ করতে করতে গুনগুন করতে শুনেছি কত রবীন্দ্রসংগীত, তাই মনে হল উইকিসংকলনে লেখাটা হয়ত এখন সহজ হবে, কোনো নতুন বিষয় ভাবার দরকার পরবে না সেক্ষেত্রে। সারা দুপুর ধরে চলল সম্পাদনা, গল্প, কতরকম অচেনা-অল্প চেনা গান নিয়ে আলোচনা! আর এসবের মধ্যেই জন্ম নিল আহা আজি এ বসন্তে পাতাটি।
আমি দিদাকে দেখছিলাম, কি অপূর্ব দেখায় মানুষকে খুব ভিতর থেকে খুশি হলে!
আমার মনে পড়ছিল ২০১১-র নভেম্বরের Wiki Conference। আমার সুযোগ ঘটেছিল,বিশাখা দত্তের দ্বারা পরিচালিত “Where are the Women?” আলোচনা সভাটিতে অংশ নেওয়ার। মনে আছে আমি বলেছিলাম, আমাদের চারপাশের সমস্ত মহিলারা, প্রতিদিনই সমাজটাকে সুন্দর করে তুলছেন আরও একটু করে, যে অর্থে আমরা মহিলাদের কন্ট্রিবিউশানের কথা নিয়ে আলোচনা করছি, আমাদের প্রত্যেকে সেই অর্থেই এক একজন কন্ট্রিবিউটার, প্রতি মুহূর্তে। শুধু সেটা অনুধাবন করতে যা দেরি!তাই আমরা, যারা একটু জানি, তারা কি পারি না, আর কিছুজনকে জানাতে? পারব না আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে? এভাবেই, আরও অনেক নারীদের সঙ্গে নিয়ে, একসাথে।
এইটুকুই তো!
চলুন, এগিয়ে যাই!
সুচেতা ঘোষাল